৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মুখে বাপেক্স

- ডেস্ক রিপোর্ট:
- 16 Aug, 2025
গ্যাসকূপ খনন প্রকল্প নিয়ে বিদেশি কোম্পানির করা মামলায় প্রাথমিকভাবে ৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মুখে পড়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্সকে। তিনটি গ্যাসকূপ খনন করতে ২০১৭ সালে আজারবাইজানের কোম্পানি সকারের সঙ্গে ৩৯৯ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি ভঙ্গসহ কয়েকটি অভিযোগ এনে বাপেক্সের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি আদালতে মামলা করে আংশিক রায়ও পায় তারা। বাপেক্স এখন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আপিলের জন্য বাপেক্স ইতোমধ্যে মামলার রায় পর্যালোচনা করেছে। রায় ও পর্যালোচনার তথ্য বিশ্লেষণ করে একাধিক আইনজ্ঞ মনে করছেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা করতে না পারা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনায় উপযুক্ত আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে না পারায় এ ক্ষতির মুখে পড়েছে বাপেক্স। মামলার বাকি রায় এলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
জ্বালানি বিভাগ ও বাপেক্স সূত্র জানায়, সকার ২০২০ সালে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে (এসআইএসি) এ মামলা করে। গত ৪ জুলাই আদালত আংশিক রায় দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলায় বাপেক্স চূড়ান্তভাবে হেরে গেলে প্রকল্পের মোট খরচের চেয়ে বেশি অর্থ দিতে হবে সকারকে। আর টাকা তারা পাবে আংশিক কাজ করে। যদিও তাদের খনন করা কূপে গ্যাস পাওয়া যায়নি। খনন কাজে কোম্পানিটির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
বাংলাদেশের স্থলভাগের তিন কূপ খাগড়াছড়ির দক্ষিণ সেমুতাং-১, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ-৪ ও জামালপুরের মাদারগঞ্জ-১ খননে চুক্তি করেছিল সকার। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সেমুতাং-১ কূপটি খনন করে তারা। তাতে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। খনন বাবদ ১৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করে বাপেক্স।
অন্য দুটি কূপ খননের প্রস্তুতি খরচ এবং খননস্থান নির্ধারণ নিয়ে সকারের সঙ্গে বাপেক্সের জটিলতা দেখা দেয়। বাপেক্সের দাবি, বেগমগঞ্জ-৪ কূপ খননের আগে প্রস্তুতির জন্য চুক্তির বাইরে গিয়ে ৭৩ কোটি টাকা অগ্রিম দাবি করে সকার। এই আগাম অর্থ দিতে রাজি হয়নি তারা। আবার সেমুতাং-১ কূপ খনন বাবদ বিল পরিশোধে বাপেক্স দেরি করেছে– এমন দাবি করে ২০১৯ সালের জুনে চুক্তি বাতিলের কথা জানিয়ে দেয় সকার। তারা জানায়, কাজ শেষ হওয়ার ২৮ কর্মদিবসের মধ্যে বিল পরিশোধ করেনি বাপেক্স।
বাপেক্সের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, সকার চুক্তির দ্বিগুণ সময় নিয়ে প্রথম কূপ খনন করে। এতে বিল পরিশোধে কিছুটা দেরি হয়, যা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত। তবে তারা সরাসরি চুক্তি বাতিল করে। এর পরও কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিল বাপেক্স। সকার তা শোনেনি। খননকাজ অসমাপ্ত রেখেই বাংলাদেশ ছাড়ে তারা। এ সময় অন্তত ছয়টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি সকার। এই দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে আজারবাইজানও বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে। তবে সকার সমঝোতায় বসেনি।
সকার পারফরম্যান্স গ্যারান্টি, রিগ আটকে রাখা, ডিমোবিলাইজেশন, আনুষঙ্গিক ক্ষতি এবং সাব-কন্ট্রাক্টরের পাওনাসহ ১১ বিষয়ে প্রায় ৮৮৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে। বাপেক্স ২০২১ সালে এই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান ফলিহগকে নিয়োগ করে। লন্ডনে ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর থেকে ১১ অক্টোবর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বাপেক্সের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে অংশ নেন তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক হাওলাদার ওহিদুল ইসলাম এবং বেগমগঞ্জ-৪ কূপ খনন কাজের প্রকল্প পরিচালক তোফায়েল উদ্দিন শিকদার। শুনানিতে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েবও ছিলেন। ফলিহগের পক্ষ থেকে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন মাইকেল সুলিভান।
গত ৪ জুলাই এসআইএসি সকারের দুটি দাবি পুরোপুরি বহাল, পাঁচটি আংশিক এবং চারটি দাবি খারিজ করে দিয়ে বাপেক্সকে ৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
রায় অনুসারে সকার ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত অভিযোগে ১১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং ‘প্লাগ অ্যান্ড অ্যাব্যান্ডনমেন্ট’ বাবদ ৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে, যা খারিজ করে দেন আদালত। একইভাবে ডিমোবিলাইজেশন সংক্রান্ত ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার দাবি অযৌক্তিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। প্রকল্পের রাস্তা তৈরির বিলম্বজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবি করা ১৯ কোটি টাকার মধ্যে সকারকে ৪ কোটি টাকা দিতে বলা হয়। আরেকটি কূপ খনন-সংক্রান্ত খরচ হিসেবে দাবি করা ৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে ৩৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা দিতে বাপেক্সকে নির্দেশ দেন আদালত।
সবচেয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল রিগ আটকে রাখার জন্য। এই দাবিতে প্রায় ৩৩ শতাংশ কমিয়ে সকারের পক্ষে ১৯৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করেন আদালত। একইভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় রিগের যে ক্ষতি হয়েছে (রিগ ডিটেনশন-লস অব রিগ) তার জন্য দাবি করা ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ কেটে ১১৪ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছেন আদালত। রিগের জন্য এই ৩০৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ শোধ না করলে প্রতিদিন ৯০ লাখ টাকা জরিমানা বাড়তে থাকবে বলে আদালত রায় দিয়েছেন।
পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাবদ দাবি করা ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং সাব-কন্ট্রাক্টর বেকার হিউজেস-এর দাবিকৃত প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা পুরোপুরি দিতে হবে বাপেক্সকে। তবে সাব-কন্ট্রাক্টর পার্কার-এর দাবির ৪০ শতাংশ কেটে ৪ কোটি ৫৩ টাকা অনুমোদন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে সমঝোতার ভিত্তিতে আরও সমন্বয় হতে পারে। আর পরিণামমূলক ক্ষতিপূরণের দাবি আংশিকভাবে মঞ্জুর হলেও সঠিক অর্থের পরিমাণ রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।
বাপেক্সের একজন ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন না করার কারণেই মামলায় হারতে হয়েছে। এসআইএসি যদি পূর্ণাঙ্গ রায়ে আগের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখেন তাহলে বাপেক্সকে মামলা সংক্রান্ত সব খরচও দিতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন আইনজীবীদের পরামর্শে ফ্রান্সের কোর্ট অব প্যারিসে আপিল করতে পারে বাপেক্স। এ মামলা চালাতে প্রতিষ্ঠানটির গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক বলেন, মামলার কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাপেক্সের আত্মপক্ষ সমর্থনের অনেক যুক্তি ছিল। কিন্তু সেগুলো সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। তিনি বলেন, এখন তো আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নেই। তাই তারা জোরালোভাবে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ মামলায় আপিল করার যৌক্তিকতা নিরূপণের জন্য বাপেক্স এখন আইনজীবী শাহ্দীন মালিকের পরামর্শ চায়। নথিতে দেখা যায়, তিনি বাপেক্সকে জানিয়েছেন, ফরাসি দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫২০ ধারার অধীনে আপিলের সুযোগ রয়েছে। এই মামলায় তিনটি বড় ব্যত্যয় ঘটেছে বলেও জানান তিনি। প্রথমত, আদালতের আরবিট্রেটর ডেম এলিজাবেথ গ্লস্টারের সঙ্গে সকারের আইনি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক রয়েছে, যা গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করেছে। দ্বিতীয়ত, ট্রাইব্যুনাল সকারের সাক্ষীদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাপেক্সের সাক্ষীদের সরাসরি হাজির হতে হয়েছে। লিখিত সুযোগ পেলে বাপেক্স আরও জোরালোভাবে নিজের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারত। তৃতীয়ত, বাপেক্সকে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, তিনি কী মতামত দিয়েছেন তা বলা সম্ভব নয়। কারণ এতে মক্কেলের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সকার চুক্তি শেষ না করেই চলে গেছে। তাদের শাস্তি পাওয়ার কথা ছিল। বিল দিতে দেরি হলেও বাপেক্স যে টাকা দেবে না, তা বলেনি। আমার মনে হয়, বাপেক্স ভালো আইনজীবী নিয়োগ দেয়নি। রায়ের বিরুদ্ধে শক্তভাবে আপিল করা উচিত।
২০২০ সালের পর দায়িত্বে ছিলেন বাপেক্সের এমন দুজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের চাপে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফলিহগকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক আদালতে বাপেক্সের হয়ে জোরালো ভূমিকা রাখেনি। ঠিকমতো তথ্য-উপাত্ত উত্থাপন করেনি। তাই বাংলাদেশ হেরেছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জ্বালানি খাতের অধিকাংশ মামলা দেখভাল করতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ ব্যারিস্টার মঈন গণি। তিনিই প্রতিষ্ঠানটিকে জ্বালানি খাতসহ দেশের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক মামলায় নিয়োগ পেতে সহযোগিতা করেন। মঈন গণি ২০১২ সালে ফলিহগের ওয়াশিংটন অফিসে এক বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মঈন গণির হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। সরকার পতনের পর থেকে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সচিব মো. আমজাদ হোসেন কে বলেন, ‘আমি দায়িত্বে নতুন এসেছি। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না।’ তবে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফজলুল হক জানান, তারা আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
সর্বাধিক পঠিত সংবাদ
